বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা অন্তত ৭০ লাখ, এর মধ্যে ৫০ লাখের মতো ইয়াবায় আসক্ত বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
দেশে মাদকসেবীর বিষয়ে সরকারের কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও মাদক নির্মূলে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের এই হিসাবে সমর্থন দিচ্ছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দিন আহমেদ।
মাদক নির্মূলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলার মধ্যে রোববার পরিসংখ্যান জানতে চাইলে বেসরকারি তথ্যের উপর নির্ভর করার কথা জানান জামাল উদ্দিন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধিদপ্তরের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এসব নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এই সংখ্যা অধিদপ্তর সমর্থন করে।”
গত ৩ মে র্যাবের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জোরাল অবস্থানের কথা জানান। এরপর দেশজুড়ে বিভিন্ন বাহিনীকে অভিযানে দেখা যাচ্ছে।
গত ১৪ মে র্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর তারা মাঠে নেমেছেন। মাদকের বিরদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনের আগে ৩০ এপ্রিল কোস্ট গার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল এ এম এম এম আওরঙ্গজেব চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, মাদকের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’।
আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানালেও গোয়েন্দা পুলিশ, রেল পুলিশ, থানা পুলিশ এবং বিজিবিকেও মাদকবিরোধী অভিযানে দেখা যাচ্ছে।
কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জেলায় পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে মাদক চক্রের চিহ্নিত কয়েকজন সদস্য নিহত হয়েছেন। শনিবার রাতে ছয় জেলায় ছয়জন নিহত হয়েছে, যার চারজনই মাদক কেনা-বেচায় জড়িত বলে পুলিশের ভাষ্য।
তার আগে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত বরিশাল কলোনিতে র্যাবের অভিযানে নিহত হন দুজন। র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে বরিশাল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত পাঁচ দিনে নয়জন নিহত হয়। নিহতরা সবাই মাদক কেনা-বেচায় জড়িত বলে র্যাবের দাবি।
রোববার দুপুর থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে র্যাবের উদ্যোগে পোস্টার, লিফলেট বিলি শুরু হয়েছে জনসচেতনতা বাড়াতে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করে বলেছেন, মাদকবিরোধী অভিযানে কাউকে ছাড় দেবে না সরকার।
এদিনই গণভবনে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা মাদক নির্মূলে অভিযান চলার কথা জানিয়ে বলেন, “আমরা যেমন জঙ্গিবাদকে দমন করেছি। আমরা অঙ্গীকার করেছি, এই মাদক থেকে দেশকে উদ্ধার করব।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহত নিয়ে সন্দেহ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনাও রয়েছে। অন্যদিকে মাদকের বিস্তারে উদ্বেগও রয়েছে সবার মধ্যে।
অভিযানের পক্ষে শেখ হাসিনা বলেন, “মাদকের জন্য একেকটা পরিবার যে কষ্ট পায়, যেভাবে একেকটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়…। কাজেই এবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান।”
ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা
মাদক হিসেবে এক সময় গাঁজা, হেরোইনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ফেনসিডিল, যা আসত মূলত ভারত থেকে। এখন ফেনসিডিল ছাড়িয়ে ইয়াবা ট্যাবলেটের দৌরাত্ম্য চলছে, যার উৎসস্থল প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার।
৭০ লাখ মাদকসেবীর মধ্যে ৫০ লাখ ইয়াবাসেবী হওয়ার তথ্য সমর্থন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন বলেন, এখন ইয়াবার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
ইয়াবা ট্যাবলেট ধোঁয়ার সঙ্গে নিয়ে নেশায় আচ্ছন্ন হন মাদকসেবীরা। এই ইয়াবায় তরুণদের আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ইয়াবা মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসে। কক্সবাজারের প্রভাবশালী চক্রের নিয়ন্ত্রণে সহজে বহনযোগ্য এই ট্যাবলেটি ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
ইয়াবা পাচারে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম সরকারি বাহিনীর তালিকায়ও এসেছিল; তবে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এই নেতা তা অস্বীকার করে আসছেন।
চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রায় ৮০ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড। বিজিবি জব্দ করেছে প্রায় ৬৩ লাখ।
গত বছর দেশের বিভিন্ন সংস্থা প্রায় ৪ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে জানিয়ে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, “এ বছরের প্রথম কয়েক মাসে জব্দের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।”
জব্দের তালিকা জানা গেলেও কী পরিমাণ ইয়াবা হাতছাড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, সেই বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “বিভিন্ন পদ্ধতিতে লাখ লাখ ইয়াবা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে রাজধানীতে ঢুকছে।”
শনিবার রাতে ঢাকার উত্তরা থেকে প্রায় এক লাখ ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান তিনি।
নানা সময়ে ইয়াবার চালান আটকের পর দেখা যায়, ছোট ছোট এই ট্যাবলেট গাড়ির যন্ত্রাংশের ভেতরে, ফলের ভেতরেও বিভিন্ন কৌশলে ঢুকিয়ে কক্সবাজার থেকে পাচার করা হচ্ছিল।